জানা অজানা - এক্সপ্লোর দ্য ওয়ার্ল্ড

বাংলাদেশ: ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য – এক বিস্তৃত পরিচিতি

বাংলাদেশ

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব টারশিয়ারি যুগের পর্বতমালায় আবৃত। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বে ভারত, দক্ষিণ পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে মিয়ানমার। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন (জুন, ২০২২ জনশুমারি অনুযায়ী)। জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯৯% মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৪.৪%। বাংলাদেশের মূল শহর ও রাজধানী ঢাকা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ঢাকা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা, শিল্প, অর্থনীতি এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র। বাংলাদেশের অন্যত্র গণপ্রজাতন্ত্রিক শাসনের আওতায় অনেক উন্নত ও প্রগতিশীল শহর এবং অঞ্চল রয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় স্মৃতিসৌধ
বাংলাদেশ জাতীয় স্মৃতিসৌধ। Photo by Feriwala Studio



বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রাথমিকভাবে কৃষি ও গাড়ি পরিবহনে ভিত্তি করে যা অপরিসীম আয় এবং কর্মসংস্থানের বাড়তির একটি উপায়। প্রস্তুত পণ্য পরিমাণের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে প্রধানত গার্মেন্টস ও পোশাক উৎপাদন, সাবান উৎপাদন, ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক পন্য উৎপাদন এবং প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদন প্রধান। বাংলাদেশের সংস্কৃতির বৈচিত্র্য একটি সমৃদ্ধ মিশ্রণ যা ইসলামি, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং আদিবাসী সংস্কৃতিক উপাত্ত থেকে উৎপন্ন। যোগাযোগের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন প্রযুক্তিগতভাবে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।  বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে সমাজ, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সুযোগ ও উন্নতির লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তির যুগে বদলে যাওয়া বিশ্বপ্রেক্ষাপটের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও লেগেছে প্রযুক্তির ছোয়া যার নাম ডিজিটাল বাংলাদেশ। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও জনগণের আগ্রহের প্রতিফলন হিসেবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবে অচিরেই। যা বাংলাদেশি জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়াবে এবং এই জাতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানের সাথে মাথা উচু করে দাড়াবে আশা করা যায়।


বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা

    এক নজরে বাংলাদেশ

    নামঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
    রাজধানীঃ ঢাকা
    সরকারঃ গণপ্রজাতন্ত্রী
    বাংলাদেশের সংসদঃ জাতীয় সংসদ ভবন, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা
    রাষ্ট্রপতিঃ মোঃ সাহাবুদ্দিন
    প্রধানমন্ত্রীঃ শেখ হাসিনা
    স্বাধীনতাঃ ২৬ মার্চ, ১৯৭১
    ভাষাঃ বাংলা
    ধর্মঃ ইসলাম (প্রধান), হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান
    মুদ্রাঃ টাকা
    জনসংখ্যাঃ ১৬,৫১,৫৮,৬১৬ জন (২০২২)
    আয়তনঃ ১৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার
    ভৌগলিক অবস্থানঃ দক্ষিণ এশিয়া, বঙ্গোপসাগরের তীরে
    সীমান্তঃ ভারত, মায়ানমার
    ভূ-প্রকৃতিঃ সমতল ভূমি, পাহাড় ও উপকূল
    প্রধান নদীঃ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র
    জলবায়ুঃ গ্রীষ্মমন্ডলীয়
    অর্থনীতিঃ উন্নয়নশীল দেশ
    জিডিপিঃ $৪১৬ বিলিয়ন (২০২৩)
    প্রধান শিল্পঃ পোশাক ও কৃষি
    রপ্তানিঃ পোশাক ও কৃষি পণ্য
    আমদানিঃ যন্ত্রপাতি, জ্বালানি
    সাক্ষরতার হারঃ ৭৪.৪% (২০২০)
    শিক্ষা ব্যবস্থাঃ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা
    বিশ্ববিদ্যালয়ঃ ৫৪টি (সরকারি ও বেসরকারি)
    সংস্কৃতিঃ বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে গঠিত। সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক মূল সংস্কৃতির অংশ
    খেলাধুলাঃ কাবাডি (জাতীয়), ক্রিকেট, ফুটবল, হকি
    প্রধান পর্যটনঃ সুন্দরবন (বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন), কক্সবাজার (বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত)
 

    বাংলাদেশের অন্যান্য জাতীয় প্রতীক সমূহঃ
    জাতীয় পতাকাঃ লাল-সবুজ
    জাতীয় প্রতীকঃ সাদা শাপলা
    জাতীয় সঙ্গীতঃ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি
    জাতীয় কবিঃ কাজী নজরুল ইসলাম
    জাতীয় পশুঃ রয়েল বেঙ্গল টাইগার
    জাতীয় পাখিঃ দোয়েল
    জাতীয় মাছঃ ইলিশ
    জাতীয় ফুলঃ সাদা শাপলা
    জাতীয় গাছঃ আম গাছ
    জাতীয় ফলঃ কাঁঠাল
    জাতীয় খেলাঃ কাবাডি


বাংলাদেশের ভূগোল

বাংলাদেশের আয়তন ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার ও সমুদ্রসীমা ১২ নটিক্যাল মাইল (২২.২২ কিমি) এবং অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল (৩৭০.৪০ কিমি) পর্যন্ত বিস্তৃত। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের 92তম বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ২০°৩৪´ থেকে ২৬°৩৮´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°০১´ থেকে ৯২°৪১´ দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের আন্তজাতিক সময়  +৬.০০ ঘণ্টা গ্রীনিচ প্রমাণ সময়। বাংলাদেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে সর্বোচ্চ বিস্তৃতি ৪৪০ কিলোমিটার এবং উত্তর-উত্তরপশ্চিম থেকে দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিস্তৃতি ৭৬০ কিলোমিটার। বাংলাদেশের উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়; পূর্বে আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম; দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপের বৃহত্তম অংশের মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশের সমুদ্রতটরেখার দৈর্ঘ্য ৫৮০ কিলোমিটার। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের উচ্চতম স্থান দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোদক মুয়াল, সমুদ্রতল থেকে যার উচ্চতা ১,০৫২ মিটার (৩,৪৫১ ফুট)। বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বিজয় (তাজিংডং) অবস্থিত যার উচ্চতা ১,২৮০ মিটার। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে বঙ্গোপসাগর উপকূলের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলায় সুন্দরবন অবস্থিত, যা বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন।


বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়।
 

উচ্চভূমি

পাহাড়ি অঞ্চল- দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু পাহাড়শ্রেণী বিদ্যমান। বালাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত তাজিংডং উচ্চতা ১,২৮০ মিটার যা বান্দরবানের রুমা উপজেলায় অবস্থিত। পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলাতেও উচু পাহাড়শ্রেণী অবস্থিত। বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত মধুপুর ও ভাওয়াল গড় যা টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজীপুর জেলায় অবস্থিত। এ অঞ্চলের সর্বোচ্চ উচ্চতা মধুপুর গড় (১০৫ মিটার)। পূর্বাঞ্চলে কুমিল্লা জেলায় ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের স্বল্প উচ্চতার ময়নামতি (উত্তর অংশ) ও লালমাই (দক্ষিণ অংশ) নামে উচ্চভূমি বিদ্যমান যার সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৬ মিটার। বালাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের পশ্চিম অংশে সমতল উচ্চভূমি যা বরেন্দ্র অঞ্চল নামে পরিচিত।


নিম্নভূমি

প্লাবন সমভূমি- দেশের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এ অঞ্চল নদী ও খাল-বিল দ্বারা পূর্ণ। উপকূলীয় অঞ্চল- দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। এ অঞ্চল নিম্নভূমি ও লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত।

 

দ্বীপপুঞ্জ

সুন্দরবন: পশ্চিম-দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। এ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। উপকূলীয় দ্বীপপুঞ্জ: বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাতিয়া, সেন্টমার্টিন, ও কুতুবদিয়া।


বাংলাদেশের নদী

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। নদীগুলো সমগ্র দেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য মতে দেশে মোট নদীর সংখ্যা ১০০৮টি। বাংলাদেশের নদী অববাহিকায় ৫৮টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত। বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো হলো- পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, কর্ণফুলী, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষা ইত্যাদি।

বাংলাদেশের নদী
বাংলাদেশের নদী



বাংলাদেশের জলবায়ু

বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে ৬টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে যথাঃ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। বছরে বৃষ্টিপাতের মাত্রা ১৫০০-২৫০০ মি.মি./৬০-১০০ ইঞ্চি; পূর্ব সীমান্তে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে এই মাত্রা ৩৭৫০ মি.মি./১৫০ ইঞ্চির বেশি। বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ২৫° সেলসিয়াস। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে। এখানকার আবহাওয়াতে নিরক্ষীয় প্রভাব দেখা যায়। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা শীতের আবহাওয়া অনুভূত হয়। মার্চের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল শুরু হয়, যখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং আবহাওয়া গরম থাকে। জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম অনুষ্ঠিত হয়, এই সময় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। পাশাপাশি, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, এবং জলোচ্ছ্বাসও প্রায়ই ঘটে থাকে।


বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন

বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন দেশের উন্নয়ন ও জনজীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ভূগোলগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান নদী অববাহিকার মধ্যে, যেখানে গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়। এই কারণে দেশের পরিবেশ বিভিন্ন নদী, জলাশয় ও বনাঞ্চলে সমৃদ্ধ, যা জীববৈচিত্র্য এবং কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে বন্যা, খরা, জলবায়ু-সংক্রান্ত দুর্যোগ এবং লবণাক্ততা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, যার ভূগোল ও জলবায়ুর কারণে বন্যা, সাইক্লোন, এবং ভূমিধস সাধারণ ঘটনা। বর্ষা মৌসুমে দেশের নদীসমূহে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হলে বন্যা দেখা দেয়, যা কৃষি ও জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এছাড়া, দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা মানুষের জীবন ও সম্পদের ওপর হুমকির সৃষ্টি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের অবকাঠামো ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করছে, তবে সচেতনতা ও প্রস্তুতির মানসিকতা তৈরি করা অপরিহার্য, যাতে জনগণ এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে সক্ষম হয়।


বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারনে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলে অকাল পানি বৃদ্ধি এবং ভূমি হারানোর হুমকি সৃষ্টি করছে। বৃষ্টির প্যাটার্নের পরিবর্তনের কারণে দেশের কৃষি উৎপাদনও প্রভাবিত হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যেমন বিভিন্ন ধরনের অভিযোজন প্রকল্প, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, এবং জলবায়ু-সচেতনতা বৃদ্ধি। স্থানীয় সম্প্রদায়কেও এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় সচেতন করা হচ্ছে, যাতে তারা নিজেদের পরিবেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।


বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য

বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ। বিভিন্ন ধরণের জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির কারণে এখানে বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ ও প্রাণী বাস করে।

উদ্ভিদঃ

উচ্চ বনঃ শাল, সেগুন, গর্জন, আম, জাম, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি।
সমতল ভূমির বনঃ শিশু, আমলকী, বেত, বাঁশ, খেজুর ইত্যাদি।
ম্যানগ্রোভ বনঃ সুন্দরী, গেওয়া, কাঁকড়া, পেঁচা ইত্যাদি।
পাহাড়ি বনঃ ওক, রিম, গর্জন, চাপালা, আগর, কাউফল ইত্যাদি।
 

প্রাণীঃ

স্তন্যপায়ীঃ বাঘ, হরিন, হাতি, গয়াল, বানর, শেয়াল, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, বিড়াল ইত্যাদি।
পাখিঃ শালিক, দোয়েল, কোকিল, বুলবুলি, পাপিয়া, ঘুঘু, বাজপাখি ইত্যাদি।
সরীসৃপঃ সাপ, গুইসাপ, টিকটিকি, কচ্ছপ ইত্যাদি।
উভচরঃ কুমির, ভোদড়, ব্যাঙ ইত্যাদি।
মাছঃ রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, গজার, মাগুর, শিং, কই, ইলিশ, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের ইতিহাস

প্রাচীন যুগ

প্রাচীন বাংলা ধীরে ধীরে অস্ট্রো-এশীয়, তিব্বত-বর্মী, দ্রাবিড় এবং ইন্দো-আর্যদের দ্বারা বসতি স্থাপন করেছিল। এই জনগোষ্ঠী বাংলা অঞ্চলে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষা নিয়ে এসেছে। এসব সংস্কৃতি ও ভাষা বাংলাদেশের বর্তমান সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশে অবদান রেখেছে। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপ চর্যাপদ অষ্টম শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশ শাসনকারী প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু সাম্রাজ্যের মধ্যে রয়েছে বঙ্গীয় সাম্রাজ্য, সমতা ও পুন্ড্র সাম্রাজ্য, মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্য, বর্মণ রাজবংশ, শশাঙ্ক রাজবংশ, খড়্গ ও চন্দ্র রাজবংশ, পাল সাম্রাজ্য, সেন রাজবংশ, হরিকেল রাজ্য, এবং দেব রাজবংশ। মুদ্রা, ব্যাংকিং, শিপিং, স্থাপত্য এবং শিল্প এই রাজ্যগুলিতে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল এবং বিক্রমপুর ও ময়নামতির প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে পণ্ডিতদের আকৃষ্ট করেছিল। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম গোপাল এই অঞ্চলের প্রথম নির্বাচিত শাসক ছিলেন; তিনি পাল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন যা ১১৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করে এবং এই সময়কালে বাংলার উন্নতি ঘটে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রাচীনতম শিলালিপিটি মহাস্থানগড়ে পাওয়া গেছে এবং এটি ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা, যা খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে লেখা বলে মনে করা হয়। এই শিলালিপি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রস্তর যুগের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। এই সরঞ্জামগুলি পাথর, হাড় এবং শিং দিয়ে তৈরি। এসব হাতিয়ার প্রমাণ করে যে, প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ এখানে বসবাস করে আসছিল। একটি তাম্র যুগের বসতির ধ্বংসাবশেষ ৪,০০০ বছরের পুরনো। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এসব ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের ইতিহাস প্রায় ৪০০০ বছর আগে তাম্রযুগ থেকে শুরু হয়েছিল।


মধ্যযুগ

২০০৬ খ্রিস্টাব্দে উরি-বটেশ্বর এলাকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ এলাকায় বসতি গড়ে ওঠে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। দ্রাবিড় এবং তিব্বত-বর্মন সম্প্রদায়ের লোকেরা সেই সময়ে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল বলে মনে করা হয়। পরবর্তীতে অঞ্চলটি স্থানীয় এবং বিদেশী শাসকদের দ্বারা শাসিত ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়। আর্যদের আগমনের পর বাংলা চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশের দ্বারা শাসিত হয়। এর পরেই শশাঙ্ক নামে একজন স্থানীয় রাজা অল্প সময়ের জন্য এই অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। প্রায় একশত বছরের নৈরাজ্যের পর (যাকে মৎসন্যায় পর্ব বলা হয়), বৌদ্ধ পাল রাজবংশ বাংলার অনেকাংশের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে এবং পরবর্তী চারশ বছর শাসন করে। এরপর হিন্দু সেন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। দ্বাদশ শতাব্দীতে সুফি ধর্মপ্রচারকদের দ্বারা বাংলায় ইসলামের প্রচলন ঘটে। পরবর্তীকালে মুসলিম শাসকরা সামরিক অভিযানের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। ১২০৫-১০৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে, তুর্কি বংশোদ্ভূত একজন সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি রাজা লক্ষ্মণসেনকে পরাজিত করেন এবং সেন রাজবংশের অবসান ঘটান। ১৬ শতকের আগে বাংলা স্থানীয় সুলতান ও জমিদারদের শাসনের অধীনে ছিল। মুঘল সাম্রাজ্য বাংলায় পদার্পণ করার পর ঢাকায় বাংলার নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর।


বাংলাদেশের ইতিহাসে মুঘল আমল

বাংলাদেশের ইতিহাসে মুঘল আমল (১৬ শতক থেকে ১৮ শতক) ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল, যা প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য বিখ্যাত। মুঘল শাসকরা বাংলায় শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো এবং স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যার ফলে কৃষি, বাণিজ্য এবং স্থাপত্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে। ঢাকা মুঘল আমলে বাংলার রাজধানী হিসেবে সমৃদ্ধি লাভ করে এবং একটি প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। মুঘল স্থাপত্যশৈলী, যেমন লালবাগ কেল্লা এবং বিভিন্ন মসজিদ, বাংলায় মুঘল শিল্প-সংস্কৃতির প্রভাবের উজ্জ্বল নিদর্শন। তবে, মুঘল শাসনের শেষের দিকে দুর্বলতা এবং আভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে ব্রিটিশরা বাংলায় তাদের প্রভাব বিস্তার শুরু করে।


বর্তমান বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবাহ ছিল, সেই সময়ে বর্তমানের বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুঘলেরা বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর দিল্লীর সিংহাসন দখলের পর থেকে ধীরে ধীরে বাংলা মুঘল শাসনের অধীনে আসতে শুরু করে। মুঘল সম্রাট বাবর ঘঘরার যুদ্ধে তৎকালিন বাংলার সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহকে পরাজিত করেন। সে সময়ে বাংলার কিছু অংশ মুঘল সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। পরবর্তিতে সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন বাংলায় মুঘল শাসনের বিস্তার ঘটান। সেখানে তিনি ছয় মাস অবস্থান করেছিলেন। শেরশাহের বিজয়ের কারণে পরে হুমায়ুন পারস্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। শেরশাহ  মুঘল এবং শাহী বাংলা উভয়ের রাজত্ব করেন। পরবর্তীতে শেরমোহের মৃত্যুর পরে পুনরায় বালা হুমাযুনের অধিন্যাস্ত হয়। সম্রাট আকবরের শাসনকালে বাংলার তৎকালীন সুলতান দাউদ খান কররাণী রাজমহলের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। বাংলা দখলে আসলে সম্রাট আকবর বাংলা, বিহার ওড়িশ্যা সহ মায়ানমারের আরাকান অঞ্চল নিয়ে একটি সুবাহ ঘোষনা করেন, যা সম্রাট আকবরের বারো সুবাহর একটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৭শ শতাব্দিতে মুঘল সাম্রাজ্য বাংলায় পুনঃরায় বিরোধীতার সম্মুখীন হয় বারো ভূইয়া নামক স্থানীয় শাসক দ্বারা, যার মূল নেতৃত্বে ছিলেন ঈসা খান। ঈসা খান ছিলেন তাদের অন্যতম। মুঘলেরা আকবরের পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ সালে ঢাকাকে নতুন মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে মহানগরী ঢাকাকে "জাহাঙ্গীরনগর" নামে নামকরণ করা হয়। তখন থেকে ঢাকা সুবাহ বাংলার বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সুবাহ বাংলার সর্ববৃহৎ রপ্তানি ছিল মসলিন। এই সময়ে মুঘলেরা আরাকান রাজ্য দখল করে এবং চট্টগ্রাম বন্দর নগরীর নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং চট্টগ্রামের নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ রাখা হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের সময়কালে শায়েস্তা খানকে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন সুবাদার ছিলেন। পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্যে বিভ্রান্তির ফলে একসময় বাংলার সুবেদার মুহাম্মদ আজম শাহ আবার সুবেদার ২য় ইব্রাহীম খান এবং সর্বশেষ সুবেদার যুবরাজ আজিম-উস-শান নিযুক্ত হন। আজম-উস-শান এর সুবাদার থাকাকালীন মুর্শিদকুলি খাঁনকে বাংলার রাজকোষসহ শাসনের দায়িত্ব দেন। আজম-উস-শান বিহারে চলে গেলে মুর্শিদকুলি খাঁন নবাব উপাধি নিয়ে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। পরবর্তীতে আলীবর্দী খান ১৭৪০ সালে দিল্লির বাদশাহ মুহম্মদ শাহের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা শাসনের অধিকার পান। নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে তার দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার নবাব হন। পরবর্তিতে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন এবং পালিয়ে যান। অবশেষে তিনি ধরা পড়েন ও নিহত হন। সিরাজ-উদ-দৌলার পর ইরেজ কর্তৃক নবাব মনোনীত মীরজাফর। মীরজাফরের পরবর্তী নবাব হর তার জামাতা মীর কাসিম। মূলতঃ মীরজাফরের সময়কাল থেকেই বাংলার শাসন ক্ষমতা ইরেজদের হাতে চলে যায়।


ইংরেজ শাসনামলঃ

পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে বাংলায় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি দেখা যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন ক্ষমতা নিজেদের হাতে নেয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে, এবং বাংলার শাসন সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, যেখানে একজন ভাইসরয় প্রশাসন পরিচালনা করতেন। ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ভারতীয় উপমহাদেশে বহুবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যার মধ্যে ১৭৭৬ সালের ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা প্রায় ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কারণে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়, যার রাজধানী ছিল ঢাকা। কিন্তু ১৯১১ সালে তৎকালীন বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিবাদের ফলস্বরূপ বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। এরপর, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশভাগের সময় ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলা প্রদেশটি পুনরায় বিভক্ত করা হয়।


পাকিস্তান শাসনামল

দেশভাগের সময় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশভুক্ত হয় এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশভুক্ত হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করা হয় পূর্ব পাকিস্তান নামে। ১৯৫০ সালে ভূমিসংস্কার আইনের মাধ্যমে জমিদারী প্রথা রদ করা হয়। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত গুরুত্ব ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। সালটি ছিলো ১৯৫২ সেই সময়ে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈরিতার প্রথম লক্ষণ হিসাবে। যা ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিত। ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নানা পদক্ষেপের কারনে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। এসময় আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটে এবং বাংলার প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯৬০ সালে ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিলে এবং  শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করলে বাংলার জনগণ ফুসে উঠে। অবশেষে বাংলার জনগনের তীব্র গণঅভ্যুত্থানের কারনে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের পতন ঘটে।

জাতীয় সংসদ
জাতীয় সংসদ


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা

১৯৭০ সালে সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বিন্তু সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেয়। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে গোলটেবিলের বৈঠকের ব্যর্থতার কারনে ২৫ মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে শেখ মুজিরকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের উপর নারকীয় আক্রমণ শুরু করে। এই হামলার সাংকেতিক নাম ছিলো অপারেশন সার্চলাইট। এই হামলায় বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পাকিস্তানী সেনা এবং স্থানীয় দালালদের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিলো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও বুদ্ধিজীবী এবং সংখ্যালঘু ও বুদ্ধিজীবী দেখামাত্রই নির্বিচারে গুলি করে মারে। এই গণহত্যা থেকে বাঁচতে প্রায় ১ কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় শরণার্থি হিসেবে আশ্রয় নেয়। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা নামক একটি স্থানে মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। তাজউদ্দিন আহমদকে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষনা করা হয়। নতুন সরকার ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরূদ্ধে বিরত্বের সাথে লড়াই করে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (তৎকালীন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট), পুলিশ, ইপিআর সহ অন্যান্য বাহিনী ও শিক্ষক, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ জনগনের সার্বিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে। প্রবল দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিবাহিনী দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনিকে পরাজিত করে। বাংলাদেশ  ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনীকে ভারতের সেনাবাহিনী সহায়তা করে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৯০,০০০ পাকিস্তানি সেনা যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হয় পরবর্তীতে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছিলো।


বাংলাদেশের সরকার

গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে জনগণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সংসদীয় প্রতিনিধির মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রিপরিষদে প্রধানমন্ত্রীই সর্বেসর্বা। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত। সংবিধান ৫৫ (২) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার প্রধান। মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় সংসদ সদস্যবৃন্দ কর্তৃক একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন।


বাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চল

বাংলাদেশ ৮টি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের নামগুলো হলোঃ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগ। বাংলাদেশে মোট ৬৪টি জেলা রয়েছে, এই জেলাগুলো বিভাগের অন্তর্গত। উপজেলা প্রতিটি জেলার অন্তর্গত। বাংলাদেশে ৪৯৫টি উপজেলা, ৪,৫৫৪টি ইউনিয়ন এবং ৮৭,৩১৯টি গ্রাম রয়েছে। এছাড়াও ১২টি সিটি কর্পোরেশন এবং ৩৩০টি পৌরসভা আছে। রাজধানী ঢাকা বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর।

বাংলাদেশের মানচিত্র - বিভাগ
বাংলাদেশের মানচিত্র - বিভাগ



বাংলাদেশের জনসংখ্যা

বাংলাদেশের জনসংখ্যা জুন, ২০২২ জনশুমারি অনুযায়ী, ১৬ কোটি ৫১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন,  যা এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি করে তোলে। জনসংখ্যার এই বিস্তৃত সংখ্যা দেশের উন্নয়ন, অর্থনীতি, এবং সামাজিক কাঠামোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কৃষি ও সেবা খাতে নিযুক্ত, তবে শিল্প এবং তথ্য প্রযুক্তি খাতে নতুন সম্ভাবনার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যুবসংখ্যার হার বেশি, যা দেশটির মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য একটি ইতিবাচক দিক। তবে, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং শহরায়ণ দেশের সামাজিক এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে তুলছে, যেমন আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং পরিবহন ব্যবস্থার ওপর চাপ।


বাংলাদেশের ভাষা

বাংলাদেশের ভাষা প্রধানত বাংলা, যা দেশের সরকারি ও প্রধান ভাষা। বাংলা ভাষার ইতিহাস প্রাচীন এবং এটি একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ধারক। দেশের মোট জনসংখ্যার 98% এরও বেশি বাংলা ভাষায় কথা বলে, যা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের একটি অপরিহার্য অংশ। বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষা ও ভাষার ভিন্নতা রয়েছে, যা দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। বাংলা ভাষা UNESCO দ্বারা ২১ ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃত, যা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে এবং ভাষার জন্য সংগ্রামের গুরুত্ব তুলে ধরে। এছাড়াও, বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি বিদ্যমান, যেমন চট্টগ্রামের চট্টগ্রামীয় এবং সিলেটের সিলেটি, যা দেশের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের বেশি পুরনো। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে ৭ম শতাব্দীতে সঙ্কলিত চর্যাপদ হলো স্বীকৃত। বাংলা ভাষায় কাব্য, লোকগীতি ও পালাগানের প্রচলন ঘটে মধ্যযুগে। বাংলা কাব্য ও গদ্যসাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৃত্য কলাগুলি প্রচলিত। সেখানে উপজাতীয় নৃত্য, শাস্ত্রীয় নৃত্য, লোকজ নৃত্য, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। দেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো খুব অল্প পরিসরে যাত্রা পালার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ বাংলার লোক সঙ্গীতে বাউল, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, গম্ভিরা, কবিগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। লোকসঙ্গীতের সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে মূলত একতারা, দোতারা, ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। নকশিকাঁথার মতো হস্তশিল্প দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অঙ্গ। দেশের গ্রামীণ সমাজে উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাক, খাবার, এবং জীবনের নানা দিক মিলিয়ে এক অনন্য সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে লোকসংগীতের ভূমিকা বিশাল, বিশেষ করে বাউল দর্শন, যা মানবপ্রেম, আধ্যাত্মিকতা ও মুক্তির ওপর আলোকপাত করে।


বাংলাদেশের ঐতিহ্য তার বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের উৎসবগুলো দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যের একটি প্রতিফলন। পহেলা বৈশাখ উদযাপন, দেশের অন্যতম প্রাচীন এবং সর্বজনীন উৎসব, নতুন বছরের সূচনার প্রতীক এবং একতা ও জাতীয় পরিচয়ের বাহক। এই দিনে মঙ্গল শোভাযাত্রা, পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ঐতিহ্য, এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেশের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত উৎসবগুলির মধ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবে বরাত, শবে কদর, মুহররম ও মিলাদুন্নবি উল্লেখযোগ্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবগুলোর মধ্যে দুর্গাপূজা, কালীপূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা, দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী, কীর্ত্তণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধদের প্রধান উৎসব হল বুদ্ধ পূর্ণিমা আর খ্রিষ্টানদের বড়দিন। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব হচ্ছে দুই ঈদ এবং দূর্গাপূজা। এছাড়াও পহেলা বৈশাখ, নবান্ন, পৌষ পার্বণ ইত্যাদি সর্বজনীন লোকজ উৎসবের প্রচলন রয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রিয়ভাবে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস পালিত হয়। ধর্মীয় উৎসবগুলো, যেমন ঈদ, দুর্গাপূজা, বুদ্ধ পূর্ণিমা, এবং বড়দিন, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যকে সম্মান ও সমৃদ্ধ করে, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করে।


ভাত ও মাছ বাংলাদেশীদের প্রধান খাবার, যেজন্য বলা হয়ে থাকে মাছে ভাতে বাঙালি। আজও গ্রামাঞ্চলে পান্তা ভাত বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও রয়েছে নানারকমের মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন- রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, সন্দেশ, জিলাপী, আমির্ত্তি, কাঁচাগোল্লা, রসমালাই বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশের পুরুষদের প্রধান পোশাক লুঙ্গি। তবে শহরাঞ্চলে শার্ট-প্যান্টই বেশি প্রচলিত। বিশেষ অনুষ্ঠানে পুরুষরা পাঞ্জাবী-পায়জামা পরিধান করে থাকেন। বাংলাদেশের নারীদের প্রধান পোশাক শাড়ি। তবে সালোয়ার কামিজেরও প্রচলন রয়েছে।


বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে ষাট গম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার, এবং কান্তজীর মন্দির বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব স্থাপত্য নিদর্শনগুলো বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস এবং স্থাপত্যকলার ঐতিহ্যের সার্থক উদাহরণ। জামদানি শাড়ি, যা ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ, এবং নকশিকাঁথা দেশের বয়ন ও হস্তশিল্প ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্য শুধুমাত্র শিল্পকলা ও সংগীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর সামাজিক মূল্যবোধ, আচার-অনুষ্ঠান, এবং গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গেও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য একসাথে দেশের মানুষের জাতিগত পরিচয় এবং ঐক্যবোধকে দৃঢ়ভাবে প্রতিস্থাপন করে।


বাংলাদেশের ধর্ম

ইসলাম বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং সরকারী রাষ্ট্র ধর্ম। মূল জনসংখ্যার ৯১.৪ শতাংশ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এর পরে রয়েছে হিন্দুধর্ম ৭.৯৫ শতাংশ, বৌদ্ধধর্ম ০.৬ শতাংশ, খ্রিস্টান ০.৪ শতাংশ এবং অন্যান্য ০.১ শতাংশ। বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং সকল ধর্মের মানুষের সমান স্বীকৃতি ও অধিকার নিশ্চিত করে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।


বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ। দেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। তদুপরি, মেয়েদের শিক্ষার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে চালু করা বৃত্তির মাধ্যমে নারী শিক্ষায় অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে, সরকার মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে আসছে। ২০১১ সালে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন ক্লাসের বই তুলে দেওয়ার প্রথা চালু হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি মাধ্যমে পাঠদান করা হয়ঃ সাধারণ পদ্ধতি, ইংরেজি মাধ্যম এবং মাদ্রাসা শিক্ষা। স্কুলে সরকারি পাঠ্যক্রম হিসেবে বাংলা, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পশ্চিমা পাঠ্যক্রম এবং মাদ্রাসা শিক্ষায় ইসলামিক ধর্মীয় শিক্ষা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়ঃ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে ৩৭টি সরকারি, ৮৩টি বেসরকারি এবং দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ছাত্র জনসংখ্যার দিক থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বৃহত্তম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রাচীনতম। প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে সরকারি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি উল্লেখযোগ্য।


বাংলাদেশের খেলা

বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। অন্যান্য খেলার মধ্যে ফুটবল বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি খেলা। এছাড়াও হকি, ব্যাডমিন্টন, ক্যারাম, দাবা খেলাও বেশ জনপ্রিয়। আরো কিছু গ্রামীণ ঐতিহ্যের খেলা প্রচলিত আছে যেমন- গোল্লাছুট, এক্কাদোক্কা, দাড়িয়াবান্ধা, বউচি, ডাংগুলি, কানামাছি, নৌকাবাইচ, লাটিম, লুডু, পুতুল, ষোলগুটি ইত্যাদি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো ক্রিকেট। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি টুণার্মেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় এবং ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা লাভ করে। সেই থেকে বাংলাদেশে ক্রিকেট নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয়েছে।



বাংলাদেশের অর্থনীতি

জাতিসংঘের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী এটি একটি উন্নয়নশীল দেশ। ২০২০ সালের আগষ্ট মাসে মাথাপিছু আয় ছিলো ২০৬৪ ডলার (১ ডলার=৮৪ টাকা)। সেই সময়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিলো ৩১.৯০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর, কারণ দেশের দুই-তৃতীয়াংশ জনগণ কৃষির সাথে যুক্ত। প্রধান কৃষিজ ফসলের মধ্যে ধান, পাট ও চা উল্লেখযোগ্য। দেশে আউশ, আমন, বোরো এবং ইরি ধান চাষ করা হয়। পাট, যা ‘সোনালী আঁশ’ নামে পরিচিত, একসময় বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস ছিল। তবে বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানি বৈদেশিক মুদ্রার মূল উৎসে পরিণত হয়েছে, এবং এই মুদ্রার একটি বড় অংশ কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যয় করা হয়। সস্তা শ্রম ও অন্যান্য সুবিধার কারণে ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে এই খাতে যথেষ্ট বৈদেশিক ও স্থানীয় বিনিয়োগ হয়েছে।  তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন যাদের ৯০%-ই নারী শ্রমিক। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি বড় অংশ আসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ হতে। বাংলাদেশে দুই ধরনের মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলিত আছে, ধাতব মুদ্রা ও কাগুজে নোট। বাংলাদেশের কাগুজে নোটকে টাকা ও ধাতব মুদ্রাকে পয়সা নামে অভিহিত করা হয়।


বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন

বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, যেখানে রপ্তানি, শিল্পায়ন এবং কৃষির আধুনিকীকরণ প্রধান ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে Ready-Made Garments (RMG) শিল্পের মাধ্যমে দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। তথ্য প্রযুক্তি এবং সেবা খাতের উন্নয়নও অর্থনীতির diversification ত্বরান্বিত করেছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার উদ্যোগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতাকে সমর্থন করছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন ও মানবসম্পদ উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।


বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় হলেও এতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বর্তমান সময়ে দেশের রপ্তানি, বিশেষ করে পোশাক শিল্প, দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তথ্য প্রযুক্তি ও সেবা খাতের উন্নতি দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার উদ্যোগ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, এবং সামাজিক অসমতা মোকাবেলা করা দরকার। অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ অত্যাবশ্যক। সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল, তবে চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ জরুরি।


বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্প

বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। কৃষি বাংলাদেশের জন্য একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ খাত।


বাংলাদেশের কৃষি খাত

বাংলাদেশের কৃষি খাত দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এই খাতে প্রধানত ধান, পাট, গম, আলু, এবং বিভিন্ন ফলমূল উৎপাদিত হয়, যা দেশের মোট উৎপাদনের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে। বাংলাদেশে কৃষি মূলত ছোট খণ্ডভূমির উপর নির্ভরশীল, যেখানে কৃষকরা তাদের জীবিকার জন্য কৃষিকাজ করেন। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা এবং লবণাক্ততা কৃষিতে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে, সরকার আধুনিক প্রযুক্তি, উচ্চ ফলনশীল বীজ, এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নে কাজ করছে। কৃষি খাতের এই উন্নতি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যাবশ্যক, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রার সাথে গভীরভাবে জড়িত।


বাংলাদেশের শিল্প খাত

বাংলাদেশের শিল্প খাত দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে Ready-Made Garments (RMG) শিল্পের মাধ্যমে। পোশাক শিল্প বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত, যা লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। এছাড়াও, টেক্সটাইল, চামড়া, জাহাজ নির্মাণ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পও উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তথ্য প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিল্পের বিকাশও লক্ষ্যণীয়, যা দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলেছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, যেমন শিল্পায়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প খাতের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক।


বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ

বাংলাদেশের বেশ কিছু খনিজ সম্পদ রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেল, চুনাপাথর, পিট ও কঠিন শিলা। এছাড়াও দিনাজপুর জেলার হাকিমপুরে লোহার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং কক্সবাজারের সৈকতের বালিতে জিরকন, ম্যাগনেটাইট, রুটাইল, ইলমেনাইট, মোনাজাইট, কায়ানাইট, গারনেট, লিউককসেন, ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া গেছে।


যাতায়াত ব্যবস্থা

২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১,৪০,৬৯৯ কিলোমিটার পাকা সড়কপথ, ৩,১১৮.৩৮, কিলোমিটার রেলপথ এবং বাংলাদেশের নদী পথের দৈর্ঘ ৬,৫০০ কিলোমিটার। সড়কপথই বাংলাদেশের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। বাংলাদেশ রেলওয়ে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই সেকেলে যদিও এই সম্ভাবণাময় খাতটিকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে কর্তৃপক্ষ অনেক প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। আবার নদীপথ মূলত বর্ষা নির্ভর। নাব্যতা সংকটের কারনে সীমিত সংখক রুট ছাড়া নদীপথ সারা বছর ব্যবহার করা যায়না। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে বিমানপথে যোগাযোগের সুপরিসর ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের ভেতরে বিভিন্ন বিমানবন্দরের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল সম্ভব। ঢাকার কুর্মিটোলায় অবস্থিত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর একটি এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট এবং কক্সবাজারেও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে। করেন। দেশের সমুদ্রপথ মূলত ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে তিনটি সমুদ্র বন্দর রয়েছে। এগুলো হল চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দর এবং পায়রা বন্দর।




বাংলাদেশের পর্যটন স্থান

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়, যেখানে রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বাংলাদেশের পর্যটন খাতের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল, কারণ দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থান এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এ স্থানগুলো বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলি নিম্নরূপ:

  • কক্সবাজারঃ পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত (১২০ কিলোমিটার) কক্সবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। সমুদ্র সৈকত ছাড়াও আছে পাহাড়ি প্রাকৃতিক দৃশ্য, মেরিন ড্রাইভ, মহেশখালী দ্বীপ, টেকনাফ, সেইন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ, ছেড়া দ্বীপ, রামু বৌদ্ধমন্দির ইত্যাদি।

  • সুন্দরবনঃ সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়ে সুন্দরবন বিস্তৃত, যার মোট আয়তন ভারতীয় অংশসহ প্রায় ১০,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবন বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ চিত্রা হরিণ, বানর, বন্য শূকর, কুমিরসহ অসংখ্য বন্য প্রাণীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত।

  • সিলেট অঞ্চলঃ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর। সিলেট চা শিল্পের জন্য বিখ্যাত। সিলেট একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র এবং এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অনেক মসজিদ, মন্দির এবং ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। এখানে অবস্থিত হজরত শাহজালাল (রঃ) ও হযরত শাহ পরাণ (রঃ) মাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় তীর্থস্থানগুলির মধ্যে একটি। জাফলং, বিছানাকান্দি, লালাখাল, সাদাপাথর ও রাতালগুল সোয়াম্প ফরেস্ট হলো জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। সুনামগঞ্জের মূল আকর্ষণ হলো টাঙ্গুয়া হাওড়। এছাড়া নীলাদ্রি লেক, বারিক্কা টিলা, শিমুল বাগান, লউরের গড় ইত্যাদি। মৌলভীবাজার জেলার পরিকুণ্ড জলপ্রপাত, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হাম হাম জলপ্রপাত ও শ্রীমঙ্গলের চা বাগান, কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্দ্যান বেশ জনপ্রিয়। হবিগঞ্জের সাতছড়ি ও রেমা-কালেঙ্গা জাতীয় উদ্দ্যান, মাধবপুর লেক উল্লেখযোগ্য।  

  • পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলঃ অসাধারন নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে পর্যটকের মনকে রোমাঞ্চকর করে তুলতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিখ্যাত। যদিও চরম সম্ভাবনাময় স্থানগুলি যোগাযোগ ও নিরাপত্তাজনিত কারনে এখনো সেভাবে পর্যটন স্থল হিসেবে গড়ে উঠেনি। এরমধ্যে জনপ্রিয় স্থানগুলি হলো- খাগড়াছড়ির আলুটিলা গুহা, ঝুলন্ত ব্রীজ; রাঙ্গামাটির সাজেক, কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝরনা, ঝুলন্ত ব্রীজ, বৌদ্ধমন্দির; বান্দরবানের মেঘলা, নীলাচল, বৌদ্ধমন্দির, চিম্বুক, নীলগিরী, রেমাক্রি, নাফাখুম জলপ্রপাত, অমিয়াখুম জলপ্রপাত, দেবতাখুম, তিনাপ সাইতার, বগালেক, তাজিংডং ও কেওক্রাডং পর্বতশৃঙ্গ সহ অসংখ্য ঝর্ণা, ছোট-বড় পাহাড় ও নদী। এছাড়াও চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থিত মন্দির হিন্দুদের অন্যতম তীর্থস্থান, খৈয়াছড়া ঝর্ণা, নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা, সহস্রধারা ঝর্ণা, গুলিয়াখালি সীবিচ, পতেঙ্গা সীবিচ, মহামায়া লেক, ভাটিয়ারী লেক বিখ্যাত।

  • রংপুর অঞ্চলঃ রংপুর অঞ্চলের তেতুলিয়া, তাজহাট জমিদারবাড়ী, দিনাজপুরের স্বপ্নপুরী, রামসাগর দিঘি পর্যটনের জনপ্রিয় স্থানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় করোতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত মহাস্থানগড় যা ৪০০০ বছরের পূরোনো সভ্যতার পরিচয় বহন করে। এই অঞ্চলটি পুন্ড্রবর্ধন বা পুন্ড্রনগর নামে পরিচিত ছিল। এ মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র।

  • রাজশাহী অঞ্চলঃ নওগা জেলায় অবস্থিত পাহাড়পুর বা সোমপুর বিহার বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পর্যটন কেন্দ্র। এটি বর্তমানে ধংসপ্রাপ্ত বৌদ্ধবিহার । বাংলাদেশের অন্যতম ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্থান এই পাহাড়পুর। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রাচীন গৌড় রাজ্যের কিছু স্থাপনা আছে যার মধ্যে ছোট সোনা মসজিদ, দারাসবাড়ী মসজিদ, তোহখানা ইত্যাদি। এছাড়া পুঠিয়াতে রাজবাড়ী ও শিবমন্দির এবং নাটোরে বিখ্যাত রানী ভবানীর রাজবাড়ী ও উত্তরা গণভবন হলো সেরা দর্শণীয় স্থান।

  • ঢাকা অঞ্চলঃ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হলো সকল প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র। লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ঢাকা জাদুঘর ও ঢাকা জাতীয় জাদুঘর পর্যটকদের আকর্ষণীয় করে। এছাড়াও নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ একটি খুব জনপ্রিয় পর্যটন স্থল। এখানে আপনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সহ সোনারগাঁ জাদুঘর, বিখ্যাত পানাম নগরের অবস্থান। এছাড়াও বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি জমিদার বাড়ী আছে টাংগাইল জেলায়, সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য জমিদারবাড়ী এবং মধুপুর জাতীয় উদ্দ্যান।


এগুলি ছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় সব জেলায় দর্শণীয় স্থান রয়েছে, যেখানে স্থানীয় জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করা সহ দর্শনীয় স্থানগুলি ভ্রমণ করার সুযোগ পাওয়া যাবে।


উপসংহার

বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের দেশ, যার প্রতিটি দিক আলাদা বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ নিয়ে গঠিত। দেশের ইতিহাস বাঙালির আত্ম-সাধনা ও সংগ্রামের কাহিনী, যা স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দেশের মানুষের জীবনযাত্রা ও মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে, যা দেশের সমাজের একটি অঙ্গ। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন বিভিন্ন খাতে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে পোশাক শিল্প ও তথ্য প্রযুক্তিতে। পাশাপাশি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন সুন্দরবন, কক্সবাজার ও পাহাড়ি অঞ্চল দেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করছে। ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশের এই বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা হয়, তবে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশ, তাই, একটি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে আরো উজ্জ্বল হতে পারে, যদি আমরা এর ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে সম্মান জানিয়ে এগিয়ে যাই।  


জানা অজানার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

Post a Comment

0 Comments